আনসার বাহিনীর বিস্তারিত ইতিহাস এবং বর্তমানের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড।

 'আনসার' মূলত একটি আরবি শব্দ এর অর্থ সাহায্যকারী। 

আনসার শব্দটি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ব্যবহার হয়। নবিজী (সা:) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনয় হিজরত করলে মদিনার যে জনগণ নবিজী (সা) ও তার সহযাত্রীদের সহযোগিতা করেছিলো তাদেরকে আনসার বলা হতো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানের শৃঙ্খলা রক্ষা ও দেশকে সহযোগিতা করার লক্ষ্য নিয়ে আনসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠা হয়।

 ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত যখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে আনসারদের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। এর পরেও নানা ঘটনা ঘটে।


মুক্তিযুদ্ধে আনসারদের ভূমিকা:

১৯৭১ সালে যখন দেশে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি পূর্ব গনহত্যা শুরু করে তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সকল আনসার সদস্যরা বাঙালিদের পক্ষ গ্রহন করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন তার সাথে সাথে প্রায় ৪০ হাজার আনসার সদস্য তাদের কাছে  থাকা অস্ত্র নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে যোগদান করেন।

 এছাড়াও মুজিবনগর সরকারের নিরাপত্তা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ, গেরিলা যুদ্ধে সহায়তা, মু্ক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ ও আহতদের চিকিৎসা প্রদান করে। এই মহান যুদ্ধ প্রায় ৬৭০ জন আনসার সদস্য শহীদ হন। 

স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে আনসারদের অবদান:

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (ভিডিপি) ও ১৯৮০ সালে শহর প্রতিরক্ষা দলের (টিডিপি) সৃষ্টি হলেও পরবর্তীতে এই দুই বাহিনী মিলে পুনরায় আনসার গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবদান অস্বীকার করার মতো না। পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও বিজিবি এর সাথে শান্তি স্থাপনে আনসারের ভূমিকা অপরিসীম।

 বিভিন্ন সময়ে সম্মুখ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৯ জন আনসার সদস্য শহীদ হয়েছে। এছাড়াও পার্বত্য জেলাগুলোতে বিভিন্ন সংঘর্ষে শতাধিক আনসার ও ভিডিপি সদস্য নিহত হয়েছে। এইসকল দায়িত্বের সাথে তারা রেলপথ ও রেলরক্ষা, সড়ক ও মহাসড়ক, বিমান ও স্থল বন্দর, বিভিন্ন স্থাপনা, ভিওআইপি এবং ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা প্রদান করে আসছে বহু বছর ধরে। 

আনসারদের বর্তমান কর্মকাণ্ড:

তবে বর্তমান সময়ে আনসার বাহিনীর কিছু সদস্যের কর্মকাণ্ডের জের ধরে দেশের অধিকাংশ মানুষ আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। বিদ্রোহী আনসারদের কাজ ও জনগনের অভিমত নিয়ে লেখা হচ্ছে নিচের অংশটুকু। 


বর্তমান বাংলাদেশে আনসার বাহিনীতে কাজ করছে প্রায় ৬১ লক্ষ মানুষ, যা বাংলাদেশের সকল জনগণের ৩.৩৮ শতাংশ। তবে এই ৬১ লক্ষ আনসার বাহিনীর মধ্যে তিনটি গ্রুপ লক্ষ্যণীয়।


  • ১. ব্যাটালিয়ন আনসার
  • ২. ভিডিপি আনসার
  • ৩. অঙ্গীভূত আনসার


১. ব্যাটালিয়ন আনসার: 

বাংলাদেশে ১৮ হাজারের মতো ব্যাটালিয়ন আনসার রয়েছে। এদের কাজ হচ্ছে (i) তাদের উপর অর্পিত প্রশাসনিক, অপারেশনাল এবং দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষা করা। (ii) দেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকার লেথাল ও নন-লেথাল অস্ত্রের আইনগত ব্যবহার করা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করা।


২. ভিডিপি আনসার:

 আনসারের মধ্যে এই ক্যাটাগরির আনসার সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের সংখ্যা ৫৮ লক্ষ ৮৭ হাজার জন। ভিডিপি আনসাররা গ্রামাঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।


৩. অঙ্গীভূত আনসার:

 অঙ্গীভূত আনসারের সংখ্যা ৯৫ হাজার, এদের চাকরির বয়স তিন বছর। তবে এই তিন বছরের পরে নতুন করে চাকরি নবায়ন করতে পারবে তারা। বর্তমান সময়ে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও শান্তি শৃঙ্খলায়  জন্য হুমকি এবং জনমনে আনসারদের প্রতি যে ঘৃণা জন্মিয়েছে তার মূলে রয়েছে এই অঙ্গীভূত আনসার। এখন পর্যন্ত জানা তথ্য মতে গত কয়েকদিনে চলমান আনসারের কর্মসূচি এবং গতকাল রাতে সচিবালয়ে হামলার পিছনে এদের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। 

আর ৯৫ হাজার আনসারের মধ্য থেকে শুধু গত ১৫ বছরেই ৪২ হাজারের অধিক আনসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার অধীকাংশের বসতবাড়ি গোপালগঞ্জ ও এই অঞ্চলের আশেপাশে। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করা ব্যাটলিয়ন আনসার এবং গ্রামের শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ভিডিপি আনসাররা এই আন্দোলনের কোন অংশেই কার্যকর ছিলো না বা অংশগ্রহন করেনি।

আনসারদের বর্তমান পরিস্থিতিতে করনীয়:

পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাচ্ছি,  ক্ষুদ্র কিছু মানুষের হটকারী সিদ্ধান্ত ও ক্যু এর জন্য প্রায় ৬১ লক্ষ পরিবার পথে বসতে পারে না এবং আনসার বাহিনীর এমন উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় ইতিহাস ম্লান হতে দেওয়া যেতে পারে না । দেশের আইন রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আবেদন তারা যেন এই হটকারী সিদ্ধান্তকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং দেশের জনগন যেন সর্বশক্তি দিয়ে তাদের প্রতিহত করে। একইসাথে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই আনসার বাহিনীর ন্যায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসীদের দমনে যথাযথ ব্যবস্থা নেয় তারা।

Post a Comment

Previous Post Next Post